বৃহত্তর খুলনার অলিতে-গলিতে, প্রান্তরে-নদীতে, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, ঐতিহ্য-কিংবদন্তীতে, মনীষীদের জীবনকথায় ছড়িয়ে রয়েছে অনেক অজানা গল্প। সেই গল্প হলেও সত্যি ঘটনাগুলোকে সক্কলকে জানাবার উদ্দেশ্যে আমাদের এই সাপ্তাহিক ব্লগ - খুলনার কথকতা। লিখছেন সুস্মিত সাইফ আহমেদ
শিল্পনগরী খুলনার ব্যস্ততম মোড় শিববাড়ি সার্কেল। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় শিববাড়ির শিব মন্দির-টা কোথায়? কিছু না ভেবেই কেউ কেউ উত্তর দিবেন, আরেহ নর্দান ইউনিভার্সিটির পাশের মন্দিরটা-ই তো শিববাড়ি। তবে প্রিয়বর কৌতূহলী চোখ! একটু ঢুঁ দিলেই দেখতে পাবেন, মন্দিরটির নাম শ্রী শ্রী শিববাড়ি কালীমন্দির যেখানে মা কালী সদাজাগ্রত। তাহলে শিববাড়ি নামটা এলো কিভাবে? আর শিবঠাকুর-ই বা কোথায়?
বস্তুত আজকের শিববাড়ি মোড়ে শিবমন্দিরের অস্তিত্ব ছিল না। তবে ভৈরবের পাশে ৫ নং ঘাটে দুটি প্রাচীন শিব মন্দিরের অস্তিত্ব ছিলই। এই মন্দিরের কারণেই মিয়াবাগ-শেখপাড়ার পশ্চিমে এবং বয়রা ও খালিশপুরের পূর্বে যে বিস্তীর্ণ গ্রাম, তার নামকরণ হয় শিববাড়ি। আজকের শিববাড়ি মোড় পূর্বে মিয়াবাগ জায়গীরের অন্তুর্ভুক্ত ছিল।আর আজকের শিববাড়ি সার্কেল থেকে ঐ মন্দিরে যাওয়ার সোজা রাস্তা ছিল বিধায় স্থানীয় মানুষরা বলতেন 'শিববাড়ি যাবার মোড়'। কালক্রমে 'যাবার' শব্দটি উহ্য হয়ে বর্তমান শিববাড়ি নামকরণ হয়েছে। হুবহু একই যুক্তিতে নদীসংলগ্ন না হয়েও খুলনা রেলওয়ে স্টেশনের পাশের মোড়টির নাম হয়েছে 'ফেরিঘাট মোড়'। যাক্ গে, অনেক ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম। আসলে আজ চৈত্র সংক্রান্তি তো! সারা বাংলার স্থানে স্থানে আজ চড়কপুজো-শিবের গাঁজন হবে। তাই ভাবলাম কোন একটা শিবমন্দিরকে নিয়েই লিখি আজকের লেখাটা।
বস্তুত খুলনাঞ্চলকে 'শিবক্ষেত্র' বললে অত্যুক্তি হবে না। এই অঞ্চলের প্রভাবশালী রাজবংশের মধ্যে 'প্রাচীন যশোহর রাজবংশ' এবং 'চাঁচড়া রাজবংশ'-র কুলদেবতা ছিলেন শিব ঠাকুর। ঐতিহ্যবাহী মন্দিরের তালিকায় রয়েছে এগারো শিব মন্দির, দ্বাদশ শিব মন্দির, চাঁচড়া শিব মন্দির, কাটানিপাড়া শিব মন্দির, চণ্ড ভৈরব মন্দির প্রভৃতি। 'জোড়া শিব মন্দির' নামেই রয়েছে ৩টি মন্দির - যশোরের মুড়লী, সাতক্ষীরার নকিপুর এবং খুলনা জেলা সদরে। আজ লিখছি খুলনার ভৈরব পাড়ের 'জোড়া শিব মন্দির' নিয়ে।
জোড়া শিব মন্দির ৩২৫ বছর পুরনো উপাসনালয়। মন্দিরের দেয়াল ফলক থেকে জানা যায়, ১১০৪ বঙ্গাব্দে মুর্শিদাবাদের দেওয়ান কৃষ্ণরাম বসু এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মতান্তরে, এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা উমাচরণ দে (যদিও এই তথ্যটি তেমন ইতিহাস সমর্থিত নয়)। এই মন্দিরের প্রথম সেবায়েত ছিলেন বিশ্বেশ্বর পাঠক। মন্দিরটির অবস্থান ছিল বড়োই মনোরম পরিবেশে। মন্দিরের পূর্বদিকে নিয়ত বহমান ভৈরব নদ। এই ভৈরব পাড়ে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, বাজার ইত্যাদি ছিল মন্দির থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে। মন্দিরের পশ্চিম এবং দক্ষিণাংশে ছিল ব্রিটিশ সরকারের রেলওয়ে বিভাগের সম্পত্তি। ১৮৮০ সাল নাগাদ খুলনায় রেল চলাচলের সুচনালগ্নে সমস্ত চার্লিগঞ্জ (বড় বাজারের পূর্বতন নাম), হেলাতলার পশ্চিমাংশ, মিয়াবাগ এবং শেখপাড়া গ্রামের উত্তরাংশ সহ সমগ্র জোড়া শিব মন্দির এলাকা রেলওয়ে অধিদপ্তরের সম্পত্তির আওতাধীন হয়ে যায়। মন্দিরের অধিকার প্রতিষ্ঠালব্ধে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করা হয়। মামলায় মন্দির সংলগ্ন জমি রেলওয়ে আওতাভুক্তি ঘোষণা এবং একইসাথে মন্দিরে অক্ষত রাখার নির্দেশ মর্মে রায় আসে। অবশ্য এই রায়ে মন্দিরের কার্যক্রম মোটেও স্থবির থাকেনি।
এই মন্দিরের উত্তরাংশে ছিল এক বিশাল দীঘি। এই দীঘির দক্ষিণ দিকে পাকা ঘাট ছিল। স্থানীয় মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীরা প্রাতঃস্নান উপলক্ষে মিলিত হতেন এই ঘাটে। ১৯৩৬ সালে (১৩৪৩ বঙ্গাব্দ) বলদেব আগরওয়াল মন্দির সংলগ্ন স্থানে একটি পরিকল্পিত বাগান নির্মাণ করেন। এছাড়া মন্দির চত্ত্বরের পূর্ব অংশে চালু ছিল একটি পাঠশালা। মহাশিবরাত্রি উপলক্ষে আয়োজিত হতো অষ্টদিবস মেলা। স্থানীয় সুশীল সমাজ, বিশেষত মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায় জোড়া শিব মন্দিরের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে প্রসিদ্ধ উপাসনালয় হিসেবে খ্যাত হয়।
তবে এই মনোরম দৃশ্যের পট পরিবর্তন হয় ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। তখন এই মন্দিরে ব্যপক ভাংচুর এবং অর্থলুট হয়। এমনকি শতাব্দীপ্রাচীন শিবলিঙ্গ দুটিও চুরি হয়ে যায়। তখন থেকে বহুদিন অব্দি এই মন্দিরের নির্দিষ্ট সেবায়েত ছিলেন না। ১৯৬৪-র দাঙ্গার পর থেকে বড় বাজারের সত্যনারায়ণ মন্দিরের সেবায়েত দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই মন্দিরে পুজো দিয়ে আসতেন। অবশ্য এটাই প্রথম মন্দির আক্রমণ ঘটনা নয়। কিংবদন্তী রয়েছে, সপ্তদশ শতকে এই মন্দির মগ জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। পরবর্তীতে উনিশ শতকে ধনাঢ্য মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছায় এই মন্দির জৌলুস ফিরে পেয়েছিল যা আবার বিপর্যস্ত হয় বিশ শতকের ষাটের দশকে।
এরপর আসে একাত্তর। আরেক দফা ভাঙচুর। তারপরও স্থিতিশীলতা আসেনি। আশির দশকে এই মন্দিরে দখল নেয় বাংলাদেশের কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার। তার সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের প্রধান ক্ষেত্র ছিল ৫ নং মাছঘাট এবং জোড়া শিব মন্দির। তখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এই মন্দিরের উপাসনা কার্যক্রম।
নব্বইয়ের দশকে এরশাদ শিকদারের পতনের পরে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে 'খুলনা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ'-র আবেদনের প্রেক্ষিতে জোড়া শিব মন্দির সংরক্ষণে উদ্যোগী হয় তৎকালীন জেলা প্রশাসন। একে একে এরশাদ শিকদারের অবৈধ স্থাপনা এবং অস্ত্রশস্ত্র অপসারিত হয় মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে। তখন নতুনভাবে মন্দিরের কার্যক্রম শুরু হয়। সেই বছরই মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী শ্রী শিবকৃষ্ণ মুন্ধড়া তাঁর পিতা-মাতা মূলচাঁদ মুন্ধড়া এবং আমচা দেবী-র স্মরণে জোড়া শিব মন্দিরের জন্য দুটি পাথরের শিবলিঙ্গ দান করেন। স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় তৎপরবর্তী সময়ে মন্দিরের পুরোহিত ও সেবাইতের দায়িত্ব পালন করছেন বিশ্বেশ্বর কাঞ্জিলাল।
এবার আসা যাক মন্দিরের নির্মাণশৈলী প্রসঙ্গে। মন্দিরটি আটচালা শিখরবিশিষ্ট। ভুমি লাগোয়া নিরেট মঞ্চের উপর দুটো মন্দিরের সদর দরজা পুবদিকে। মন্দির দুটির দক্ষিণ অংশেও রয়েছে দুটি খিলান দরজা। মন্দিরের সম্মুখভাগের দরজা খিলান নকশার মধ্যে সংস্থাপিত। খিলান নকশায় নান্দনিক খাঁজকাটা ভাজ অবতলপটে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দক্ষিণাংশের চূড়ায় একটি ত্রিশূল সংস্থাপিত। মন্দিরের গাঁথনির ইটের আকার বেশ ছোট এবং মশলা হিসেবে চুন মিশ্রিত ইটের গুড়া।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক সহায়তায় বর্তমানে ২য় দফায় সংস্কারের কাজ চলছে। নাটমন্দির নির্মাণ এবং অপরাপর সংস্কার বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৬ লাখ ৯৯ হাজার টোকা।
জোড়া শিব মন্দির খুলনা শহরের অনন্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই মন্দিরের গরিমা বারবার ভুলুন্ঠিত হয়েছে বহিঃশত্রু আক্রমণ, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা সন্ত্রাসী দখলের জন্য। তবুও আজ এই মন্দিরটি স্বমহিমায় টিকে আছে শহর খুলনার বুকে। যদিও পুরনো দিনের স্থাপত্যশৈলীর ছিটেফোঁটা-ও আজ জোড়া শিব মন্দিরে পাওয়া যাবে না, তবুও তিন শতাধিক বৎসর পুরনো পুরাকীর্তি - এটাই আনন্দ সংবাদ!
তথ্যসূত্র:
১.খুলনার পুরাকীর্তি, ড মিজানুর রহমান, পৃষ্ঠা ৯৯-১০২
২.শহর খুলনার আদি-পর্ব, আবুল কালাম সামসুদ্দিন, পৃষ্ঠা ৩১-৩২
৩.বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: খুলনা, বাংলা একাডেমি, ৯৭-৯৮
৪.বিস্মৃতির অন্তরালে, দবিরউদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা ১০৫
৫.খুলনা শহরের ইতিকথা, মীর আমীর আলী, পৃষ্ঠা ৪৪
৬.মহানগরী খুলনা: ইতিহাসের আলোকে, ড.শেখ গাউস মিয়া, পৃষ্ঠা ৯৩৯
No comments:
Post a Comment